বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

হার্ট এটাক

"রোম্যান্টিক" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান Opu Ahasan (০ পয়েন্ট)

X হঠাৎ একটা দূর্ঘটনায় পড়তে যাচ্ছিল ছেলেটা। মেয়েটা তাকে বাঁচিয়ে ফেলল।আমার ঘাড় হতে মাত্র কয়েক মিলিমিটার দূরত্ব বজায় রেখে নিজ দায়িত্ব সগর্বে পালন করেই বাসটা সাঁইইই- করে প্রায় উড়ে ছুটে গেল নিজ গন্তব্যের দিকে। তার দায়িত্ব পালনে আমি অবশ্যি একটা বাধা হতে পারতাম, যদি না কোনো দয়াবতী মায়াবিনী চশমা পড়া তরুণী দয়াপরবেশ হয়ে আমার হাত ধরে হেঁচকা টানে আমাকে বাসের অপ্রীতিকর মুখমণ্ডলের সাথে ধাক্কা লাগার হাত থেকে বাঁচাতেন। তাঁর হাতের হেঁচকা টানে জোর আছে বলতে হবে। সরাসরি হাত থেকে ঘাড় বেয়ে মেরুদণ্ড চলে গেছে। এতে করে কিডনীতে স্ট্রোক হওয়ার বিধান থাকলে আজ আমার একটা কিডনী স্ট্রোক হলেও হতে পারত। আমি দাঁড়িয়েছিলাম মহাখালির বাসস্ট্যান্ডের কাছে। অনেকটা হিমু হওয়ার বাসনায় হেঁটে যাচ্ছিলাম ভবঘুরের মত। আফসোস! কিছু অপ্রত্যাশিত বৈশিষ্ট্যের দরুণ তা হতে পারলাম না। যেমন- পায়ের জুতা জোড়া। দিন দুনিয়ার কোন খবর ছিল না। খুব নাটকীয় ভঙ্গিতে হাঁটা প্র্যাক্টিস করছি। বাসটা যদি চিড়ে-চ্যাপ্টা করে চলেও যেত, তাও বোধহয় টের পেতাম না। আমার জীবন রক্ষাকারিনীর দিকে তাকালাম। তিনি রীতিমত হাঁপাচ্ছেন। আমাকে টানার জন্য যে তাঁকে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে, বোঝা যাচ্ছে। ওজনটা বেড়ে গেল নাকি? "করছেন কী? দেখে চলতে পারেন... " তাঁকে বলার সুযোগটাও দিলাম না। ধমকে উঠলাম, "এটা কী করলেন? জানেন কী করেছেন? জানেন কি হতে পারত?" তরুণী তাঁর গালভরা চশমার মোটা কাঁচের ভিতর থেকে আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছেন। ভ্রু জোড়ায় দিশেহারা ভাব। এখনও পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারেন নি। বোঝার চেষ্টা করছেন। "মানে কী? কী হতে পারত?" "অনেক বড় দূর্ঘটনা ঘটতে পারত। আচমকা টানতে গেলেন কেন?" "হ্যাঁ! অনেক বড় একটা দূর্ঘটনা ঘটতে পারত... যদি না টানতাম। পুরো পিষে দিয়ে চলে যেত বাসটা!" সরু চোখে বিরক্তি এনে বললেন তরুণী। "তাতে ক্ষতি কী ছিল? লাভই তো হত!" বললাম আমি। "মানে!" আরেক দফা ভিরমি খেল মেয়েটা। "যদি দূর্ঘটনা ঘটত, বাসটা ধাক্কা দিত, আমার চিকিৎসার খরচ বাস কোম্পানীরই দিতে হত, জরিমানাও দিতে হত! আর যদি মারাও যেতাম আমার পরিবার ক্ষতিপূরণ ঠিকই পেয়ে যেত! এখন যে আপনি আমাকে টেনে এনে বাঁচিয়ে দিলেন, বাস তো পগারপার! এখন, "মরে যেতে পারতাম" এই টেনশনে যদি হার্টএট্যাক করি? স্ট্রোক করে বসি? বলুন! তার দায় কে নেবে? বাস কোম্পানী নেবে? নাকি আপনি নেবেন? মেয়েটা বিস্ফোরিত চোখে অপলকে তাকিয়ে বলে উঠল, "কী লোক রে বাবা! আপনাকে বাঁচালাম বলে কোথায় একটু ধন্যবাদ দিবেন, তা না! জরিমানা নিয়ে পড়ে আছে।" "কী করব, আপা? গরিব আদমি আছি!" "বাসটায় লোকজন ভর্তি ছিল। বাসের ওজনের চেয়ে বেশি মানুষের ওজন হবে। ঐ বাসের নিচে পড়লে আর দেখতে হত না!" "সমস্যা কী ছিল? কাছেই তো পঙ্গু হাসপাতাল...!" আমাকে শেষ করতে না দিয়েই বিরক্ত হয়ে বলল মেয়েটা, "কী আর করবেন? মাফ করে দিন! চলে যাই! ভুল হয়ে গেছে আমার। আর কোন দিন কারো উপকার করব না! মেয়েটা চলেই যাচ্ছিল। আমি রাস্তা আটকে বললাম, " না না নাহ্! এত সহজ নাকি? আমার জরিমানা লাগবে!" বড় বড় কাঁচের ভেতর থেকে বড় বড় চোখ দুটো তুলনামূলক সরু করে মেয়েট বলল, " জরিমানা? কীসের জরিমানা?" "আজ যদি আমি হার্টএট্যাক করে মরে যাই? আমার আত্মীয়স্বজন তখন আপনাকে পাবে কোথায়?" মেয়েটা অসহায় ভঙ্গিতে বলল, " কী করতে বলছেন?" "আমাকে ঠান্ডা হতে হবে। বেশি অস্থিরতায় হার্টএট্যাকের সম্ভবনা বেশি। ডাক্তার আংকেল বলেছে।" "তো?" "আমাকে বেশি না ... কয়েক গ্লাস কোল্ড কফি খাওয়ালেই হবে।" "বেশ! আপনাকে টাকা দিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে নিয়েন।" "না না না! টাকা দিলে হবে না। আমি কয় কাপ খাব আমি নিজেও জানি ন!" "আমার কাজ আছে।" "কোন বাহানা না! ভুল করবেন আর ভুলের মাশুল দেবেন না? তা তো হয় না!" মেয়েটা কতক্ষন ঠোঁট কামড়ালো। পরে ঠোঁট কামড়ানো শেষ করে বলল, "আচ্ছা চলুন। তবে তাড়াতাড়ি। আমার তাড়া আছে। ""উহু! তাড়াহুড়া করলে চলবে না। হার্ট অস্থির পর্যায়ে আছে। তাড়াহুড়া করলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। ডাক্তার আংকেল বলেছে।" "আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। ধীরে ধীরেই চলুন!" তরুণী আমার যুক্তির কাছে হার মানলো। আমরা একটা কফিশপে ঢুকলাম। কফেশপের নাম 'কফি ডট কম'। এই নামকরণের হেতু খুঁজে পেলাম না। এখানে কি অনলাইনে কফি অর্ডার করা হয়? নাকি অনলাইনে কফি বানানো হয়? এইসব ভার্চুয়াল জিনিসপত্রে বাস্তবজগৎ ভরে যাচ্ছে! বোধহয় ফেসবুক টুইটারে মেতে থাকা জনগোষ্টির দৃষ্টি আকর্ষণই এই নামকরণের উদ্দেশ্য। তুলনামূলকভাবে জায়গাটা ভালোই। ঘাস আর ফুল জাতীয় টবে সাজানো। কাঠের মেঝে। কাচের গ্রিল বিহীন জানালা। অজ্ঞাতনামা তরুণীর নাম এখনো জানা হল না। নাম জিজ্ঞাসা করার সাহস পাচ্ছি না। আমরা বসেছি রাস্তার দিকের বারান্দার টেবিলে। পায়ের কাছেই কত গুলো ছোট ছোট টব। বেচারি এমনেতেই মনে হয় আমার কর্মকান্ডে বিরক্ত। নামের কথা তুললে টব ছুড়ে মেরে আমার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করে ছলে যাবে। সেক্ষেত্রে অবশ্য জরিমানা বা কফির বিল নিয়ে তাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। কফিশপের মালিকই ভরপাই করবে। ব্যাটারা এতগুলো টব রাখবেই কেন যা ছুঁড়ে মারা যায়? আমি কফির স্ট্রতে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে গেল। যাক! জরিমানা একটু কম দিলেও চলবে। এত ভাল কফি বানায় যেহেতু... আমি কয়েক ঢোক গিলে রাজকীয় ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভেঙ্গে নিশ্চিন্তে বসলাম।এই মূহুর্তে আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নাই। পাশ্চাত্যের লোকেরা এই ভঙ্গিতে বসে সানবাথ নেয়। অজ্ঞাতনামা তরুণী ভয় পেয়ে গেল। আমার হাবভাব দেখে নিশ্চয়ই বুঝে গেছে আমার দেরি হবে! "আপনি একটু তাড়াতাড়ি করুন, প্লিজ। আমাকে উঠতে হবে।" "আরে, বসুন তো।এত যাই যাই করছেন কেন?" "আমার সময় নাই।" "আচ্ছা। আমাকে আপনি কেন বাঁচালেন?" মেয়েটা কিছুটা বিরক্তি গলায় এনে বলল, "কারণ, কোনো এক কুক্ষণে আপনার জীবনটা আমার কাছে ঐ বাস কোম্পানীর দেওয়া"তাহলে আমার জীবনটা নিশ্চয়ই আপনার সময়ের চেয়েও বেশি দামি। চুপ করে শান্ত হয়ে বসুন। কফি খান। আমি কিন্তু কোনো জরিমানা দিতে চাই না।" "আপনি কেন জরিমানা দিতে যাবেন?" "বাহ! আপনার যদি হার্টএট্যাক হয়ে যায়, আমার জরিমানা দিতে হবে না?" "আমার হার্টএট্যাক হবেই বা কেন?" "আপনি যে হারে যাই যাই করছেন, আপনার মন অস্থির হবে। মন অস্থির হলে হৃৎপিন্ডে রক্ত বেশি বেশি পাম্প হবে। হার্ট এট্যাকের সম্ভবনা বাড়বে। ডাক্তার আংকেল বলেছে।" "ওরে বাবা!" "হুম! আমি কি এতই বোকা যে জেনে শুনে জরিমানা দিতে যাব?" "বোকা? না! না! সেটা তো আপনাকে কিছুতেই বলা যাবে না!" "হুম। কফি খান। ভাল লাগবে।" "আপনিই খান কফি। আমার এত সময় নেই।" "আমি যত কাপ খাব, তাতে আপনি দু'এক কাপ কফি আরাম করে খেতে পারবেন। অর্ডার করি?" "হুম।" মেয়েটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল। আমি আরো দুটো আমেরিকানো অর্ডার করলাম। মেয়েটা কফির কাপে চুমুক দিল। আমি দেখতে চাই, কফি যেভাবে আমার হৃদয় স্পর্শ করে, আমার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়, তেমনটা সবার হয় কিনা। তখন তাদের দেখতে কেমন লাগে? দেখা হলো না। ফোন বেজে উঠল। 'Excuse me' বলে ফোন হাতে একটু দূরে হেঁটে গেলাম। বাবা ফোন করেছেন। কথা শেষে ফোন রাখলাম। মেজাজ তখন তিরিক্ষি। ঠিক হচ্ছে না। কিছু ঠিক হচ্ছে না। একেই বোধহয় বলে 'ঘোর কলিকাল'।যখন কিছুই ঠিকমতো চলে না। সব রাগ, অভিমান, দুঃখ, হতাশা- কেন্দ্রীভূত হল আমার ফোনের ওপর। এটাকে কেন বগলদাবা করে নিয়ে এলাম? ফোনটার দিকে ভস্মদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছি। যত নষ্টের গোড়া! এটা না থাকলে কবেই ঢাকার রাস্তায় হারিয়ে গিয়ে হিমু হয়ে যেতে পারতাম। কেউ আমাকে খুজেই পেত না। হিমু হওয়ার পথে আরও একটা প্রতিবন্ধকতা। একটা আছাড় দিতে পারলেই অবশ্যি কেল্লা ফতে! কিন্তু এই একটা জিনিসই বলতে গেলে আমার একার। ছাত্র জীবনে শখের বশে টিউশনি করে জমিয়ে কিনেছিলাম। বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে, এমন আট-দশটা ফোন আমার নিজস্ব জাদুঘরেই আছে! কিন্তু সবক'টাই বাবার টাকায়। এটাই শুধু আমার। তাই মোহভঙ্গ করে আছাড়টা মারতে পারছি জরিমানার থেকে বেশি দামি মনে হয়ে ছিল। "আমি ফিরে গেলাম টেবিলে। অজ্ঞাতনামা মেয়ে কফির মগের দিকে গরম চোখে তাকিয়ে আছে। চরম বিরক্তি সেই চাহনিতে। এই দৃষ্টিতে তাকে বেশ মানিয়েছে। মেয়ে বলেই কি মানিয়ে গেছে? কোন ছেলে যদি এভাবে তাকাতো, মানাতো? আমি ডিপজলকে কল্পনা করলাম, "গরম চাওনি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ধরতে পারলেই গিলে খেয়ে নিবে!" না আ আ আহ! ভাগ্যিস এটা সত্যি না। শেষ পর্যন্ত ডিপজলের 'ইয়া ঢিশুমা' মার্কা ঘুষি খেয়ে নিজের পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বহুদিনের সাধ পূরণ করতে চাই না। পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আরও অনেক পথ আছে। আমি আবার অপরিচিতার দিকে তাকালাম। সে এখনও গরম চোখেই তাকিয়ে আছে। তবে লক্ষ্যবস্তু ভিন্ন। এবারের লক্ষ্যবস্তু কফিমগ না, আমি। ডিপজলের মত ঘুষি না দিক, হাতের কাছের টবটা ছুঁড়ে মারলেও আমি ইমার্জেন্সি ইউনিটে ভর্তি হতে পারব। হটাৎই মনে হলো, যখন-তখন যার-তার উপর রাগ করাটা মেয়েদের জন্মগত অধিকার! এই অধিকারটুকু তাদের দেওয়া উচিত। এটা শুধু মেয়েদেরই মানায়। বিশেষ করে এই মেয়েটাকে। যদিও ডিপজলের হাতের ঘুষি খাওয়ার ব্যাপারে আমার কিঞ্চিৎ আগ্রহও ছিল না, কিন্তু মেয়েটার হাতের টবের বাড়ি খেতে আমার কোনো আপত্তি নাই। আমি চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, "আপনাকে অনেক বিরক্ত করছি। তাই না?" মেয়েটা ভ্রু কুঁচকালো। এবার তাতে বিরক্তি ছিল না। ছিল বিস্ময়। 'বলে কী মিয়া' টাইপ বিস্ময়। তবে মুখে কিছু বলল না। "সরি। আপনি আমাকে একটা সম্ভাব্য এক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচালেন, আর আমি ব্যাপারটা প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে এলাম। আই'ম রি'লি সরি!" "হুম, ইট'স ওকে।" ভ্রুদুটি কিঞ্চিৎ স্বাভাবিক হলো। "আসলে ধন্যবাদ দিতে গেলে আপনাকে ছোট করা হয়। তাই চাচ্ছিলাম আপনার সাথে এককাপ হয়ত বা একটু পুষিয়ে দেয়া যাবে। আর তখন আপনাকে সরাসরি বললে হয়ত আপনি আসতেন না। তাই একটু নাটক করলাম।"অপরিচিতা হেসে ফেলল। ভ্রুজোড়া পুরোপুরি সকাভাবিক হয়ে এল। "এবার যেহেতু সব ঠিক-ঠাক আপনার সাথে আরেক কাপ কফি খেতে পারি?" "আপনার ডাক্তার আংকেল আপনাকে বলেন নি? বেশি কফি খাওাও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।" আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। সে বলল, "তিন কাপ অলরেডি হয়ে গেছে। পরে যদি হার্ট এট্যাক হয়েও যায়, জরিমানা তো আমাকেই দিতে হবে!" আমি হা হা করে হেসে উঠলাম। "তাহলে? প্রাণে বাঁচানোর জরিমানা তো শোধ হলো না!" "এরা খুব ভাল পেস্ট্রি বানায়। কফি ছাড়াও আরও অনেককিছু আছে। চিন্তা করবেন না। আজ আপনার জরিমানা শোধ না করে যাব না। হাহাহা!" আমি পেস্ট্রি খেতে খেতে বললাম, "আপনি কী বোকা! আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তো সাংঘাতিক সমস্যায় পড়তে পারতেন।" মেয়েটা চশমাটা নাকের দিকে ধাক্কা দিয়ে বলল, "কেন? কী এমন ভুল করলাম?" "যখন আমরা কফিশপ খুঁজছিলাম, রাস্তাতেই একটা ট্রাফিক পুলিশ ছিল। আপনি চাইলেই বলতে পারতেন যে আমি আপনাকে বিরক্ত করছি। তখনই আপনি ছাড়া পেয়ে যেতেন।" মেয়েটা গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, "হুম। ভুল হয়ে গেছে।" আমি হেসে বললাম, "আমার জন্যে অবশ্য ভালই হয়েছে। সেরকম হলে আমাকে আর দেখতে হতো না।" মেয়েটা হাসলো । আমি বললাম, "তবে আর যদি কখনও কেউ এমন প্যাঁচে ফেলতে চায়, প্যাঁচে পড়বেন না কিন্তু! দিন কাল ভাল না। মনে থাকবে?" "মনে থাকবে। ধন্যবাদ।" ""আরে না! আমার জীবনরক্ষাকারিনীর জন্য এটুকু তো করতেই পারি।" "আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রশংসা করতে হয়। ট্রাফিক পুলিশ যে ছিল, পুলিশকে যে বলা যেত, খেয়ালই করি নি! আচ্ছা! আপনি কি শখের গোয়েন্দা নাকি?" "না। তবে বইয়ের গোয়েন্দা। মানে তুখোড় বইপোকা। বইপোকাদের পর্যবেক্ষণশক্তি ভাল হয়। হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।""ও! আপনার তো তাহলে বিশাল সংগ্রহ নিশ্চয়ই!" "অবশ্যই! প্রায় তের হাজার।" "আমার তো হিংসা হচ্ছে।" "দেখলে আরও হিংসা হবে।" "দেখব না হয় একদিন।" ""তাহলে আমার ফোন নাম্বারটা রেখে দিন। যেদিন দেখতে মন চাইবে, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে চলে আসবেন। আমার আবার বই দেখাতে ভালই লাগে।" "তাড়াহুড়ো কীসের? নাম্বার নেওয়া যাবে এক সময়। ডাক্তার আংকেল বলেছেন না তাড়াহুড়া না করতে?" বলেই হেসে ফেলল অপরিচিতা। সে তখন আর অপরিচিতা নেই। তাকে কাছের কেউই মনে হচ্ছে। তাকে কি ব্যাপারটা খুলে বলা যায়? আমি পায়ের কাছে থাকা টবগুলোর দিকে ভীতসন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে একটা ঢোক গিললাম। "আপনার কি তাড়া আছে?" জিগেস করলাম আমি। "ছিল।। এখন নেই।" রহস্য রেখে বলল সে। "আমার একটা উপকার করা যায়?" মেয়েটা কৌতুহলী হলো, "বলুন দেখি।" "আসলে আজ আমার পাত্রীর সাথে দেখা করার কথা। পাত্রী বলতে বিয়ের পাত্রী। আমার বাবা বিয়ে নিয়ে আমার পেছনে পড়ে গেছে। মোটামুটি সব বিয়েই আমি ভেঙ্গে দিয়েছি। কিন্তু এটা মনে হয় না আমি নিজে পারব। আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি না। কিন্তু এটা আমার কথায় ভাঙ্গবে না। কারণ পাত্রী আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে। কিন্তু ভাঙ্গতে পারে, যদি পাত্রী নিজে বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়।" "ও... তো কী করতে বলছেন?" "আপনি আমাকে একটু সাহায্য করবেন?" "কীভাবে?" "সারা আর কিছুক্ষণের মাঝেই চলে আসবে। বাবা ওকে এই ঠিকানাই দিয়েছে। আপনাকে শুধু একটু অভিনয় করতে হবে। যেন আপনি আমার প্রেমিকা।" মেয়েটা একটু ভাবনায় পড়ে গেল। "দেখুন! না করবেন না। নেহাতই বিপদে পড়েছি। নাহলে কখনও এ কথা বলতাম না।" "আচ্ছা।" মেয়েটা হেসে রাজি হয়ে গেল। আমরা পরবর্তী ঘটনা ঘটানোর সরঞ্জামাদি তৈরি করে তুলে রাখলাম। ততক্ষণে আরও দুটো ব্ল্যাকবেরী আইস্ক্রিম পটল তুললো।"আপনি কি ঢাকার স্থানীয়?" আমি জিজ্ঞেস করলাম, "আসলে আমি নিজে এই কফিশপে নতুন এসেছি। অথচ বললেন আপনি এখানে আগেও এসেছেন। তাই আর কি!" "আসলে..." একটু থেমে বলল, "আমি বাংলাদেশেও নতুন। আমি ইউ.এস. এ বড় হয়েছি। জন্মসূত্রে বাংলাদেশি। এই কফিশপের ব্যাপারে আমিও কিছুই জানি না। হাঁটতে হাঁটতে কখনও আসা হয়েছিল।" আমি প্রথমবারের মত অপরিচিতার বেশভূষা জরিপ করলাম। হালকা সবুজ শাড়ি, হাতভর্তি চুড়ি, কাল চুল, চোখও কালো। কোথাও আমেরিকার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই! "সত্যি? আপনাকে দেখি পুরোপুরি বাঙ্গালি মনে হয়।" "বিদেশে থাকলেই কি কেউ বিদেশী হয়ে যায়? তাছাড়া, রক্তের টান তো ছিলই। বাংলাদেশের প্রতি আমার নিজেরও একটা আগ্রহ ছিল। এই দেশে আমি জন্মেছি। আর এদেশ থেকেই এতটা দূরে এতদিন? থাকলাম কী করে?" প্রথমবারের মত আমি তার ভাষা আর উচ্চারন মন দিয়ে শুনলাম। একদম বিশুদ্ধ। তবে এখন একটু ভাঙ্গা-ভাঙ্গা ভাব বোঝা যাচ্ছে। মেয়ে মিথ্যা বলছে না। শেষ বিকেলের রোদ পড়ে যাচ্ছে। গত তিন ঘণ্টা ধরে আমরা এই কফিশপে বসে আছি। এখন চুপচাপই বসে আছি। অপেক্ষা করছি সারার। "সারা যে কেন এত দেরী করছে! যত তাড়াতাড়ি আসবে, তত তাড়াতাড়িই তো ঘটনা ঘটবে!" "কোথায় আছেন তিনি?" "বাবা যেমনটা বলল, কার সাথে যেন মিটিংয়ে আছে।" "মেয়েরা কাজেই দেরি করে। সময়ের ব্যাপারে ওরা খুব নিঁখুত হয়। তা-ও আবার দেখা করার ব্যাপারে। নিশ্চয়ই কাজেই আছেন। অকারণে দেরি করার কথা নয়।" "আপনি তো অকারণেই দেরি করছেন।" মেয়েটা মিষ্টি করে হাসলো । "হয়ত বা এর পেছনেও কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। যে যুক্তি মেনে আমার অবচেতন মন আমাকে দেরি করতে বলছে। হতে পারে না?" লক্ষ্য করলাম, মেয়েটার মাঝে বিন্দুমাত্র তাড়া নেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ দৃশ্য খুবই বিরল। মেয়েদের এতটা সময় বাড়ির বাইরে, তাও একটা ছেলের সাথে থাকার কথা না।অবশ্য আমেরিকায় বড় হওয়া মেয়েদের কথা ভিন্ন। "আচ্ছা, আপনার নামটা তো জানা হলো না! By the way, আমি রাজিব। রাজিব রাইয়ান।" মেয়েটা রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলো। সেই হাসিতে এতটাই রহস্য সুপ্ত ছিল যে, আমার গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল। ও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, আমিও। আমরা হেঁটে মোটামুটি ব্যস্ত রাস্তার দিকে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। শেষ বিকেলের সোনালী আলোয় অপূর্ব দেখাচ্ছে সবকিছু। মেয়েটা বলে উঠলো, "তুমি হিমু সিরিজের কোনো বই পড়েছ?" "অবশ্যই! হিমুকে ছাড়া বাংলাদেশের কোনো বইপোকার উৎপাদনই সম্ভব না!" তখন আমি 'আপনি'টা হঠাৎ 'তুমি'তে নেমে যাওয়ায় চিন্তিত। "আমারও খুব পছন্দের চরিত্র। একটা গল্পে হিমু বলেছিল, বাংলাদেশের শেষ বিকেলের আলোতে সবাইকে সুন্দর দেখায়।..." "হুম।" নিশ্চয়ই বলবে না নাম 'রূপা'! আমি শুনে গেলাম। "এই শেষ বিকেলের আলোর অন্য নাম কনে দেখা আলো। আচ্ছা, বিয়ের কনেদের কি এই আলোতে দেখতে হয়? তাহলে এমন অদ্ভুত নাম কেন?" "কী জানি।" "নাম-পরিচয় ইচ্ছে করেই দিই নি এতক্ষণ। ইচ্ছে করছিল এই আলোটার অদ্ভুত নামকরণ সার্থক করতে। তাই চাইছিলাম এই কনে দেখা আলোতেই কনের পরিচয় দেব।" "মানে?" আমার মাথার ওপর তৎক্ষণাৎ সাড়ে তিনশ' টনের আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। (ওজন তার বেশিও হতে পারে) "আমি সারা। সারা হাসান।" আর আমি অবাক, বিস্মিত, টাশকিত। আমি হতভম্ভ। এক এক করে সব মেলালাম। সারাও তো আমেরিকায় বড় হয়েছে! আর ওর ভাষা তো বিশুদ্ধ হবেই! ও তো বাংলা ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করেছে! আর সেই সূত্রেই তো দেশে ফিরেছে! বাবা তো ছবি দিয়েছিল! আমি ইচ্ছে করেই দেখি নি। ইশ! কেন যে দেখলাম না! সারা আমার মুখভঙ্গি দেখে খিল খিল করে হেসে ফেলল। সেই হাসির রিনঝিন শব্দ আমার কান হয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে সরাসরি আঘাত হানল। মধুর সে আঘাত!"রাজিব, তুমি তুখোড় বইপোকা হলেও হতে পারো। তবে তোমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এতটাও তুখোড় না। তুমি শুধু ট্রাফিক পুলিশের কাছে সাহায্য না চাওয়াটাই লক্ষ্য করলে। সাহায্য না চাওয়ার কারণটা তো খুঁজতে গেলে না!" আমি সাড়ে তিন ঘণ্টা পেছনে ফিরে গেলাম। ঠিকই তো! "পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের যেকোনো মেয়েই ঐ মুহূর্তে ঐ কাজটা করত। করাটাই যুক্তিসঙ্গত। যে করবে না, সে মস্ত বোকা। মানুষ এতটা বোকা হয় না। বিশেষ করে মেয়েরা। বিশেষ করে এই ক্ষেত্রে। চিৎকার করে লোক জড়ো করার প্রতিভা তাদের জন্মগত। কিন্তু আমি তা করলাম না। কিন্তু, কেন করলাম না?" নাটকীয় একটা বিরতির পর ও বলে উঠলো, "আমি তোমাকে চিনতে পেরেছিলাম, তাই।" আমি অসহায়ভাবে হাসলাম। সারা বলল, "আমি এতক্ষণ খুব তাড়াহুড়ো করছিলাম। হঠাৎ করেই তাড়া কমে গেল। কিন্তু কেন? খেয়াল কর নি? আমার তাড়া তো তখনই কমার কথা, যখন আমার যেখানে থাকার কথা, আমি সেখানেই আছি।" আমি আমার পায়ের কাছের সর্বনিকটস্থ ক্যাকটাসের টবটার দিকে তাকালাম। টবটা আমি নিজের মাথায় ভাঙ্গতে পারলে শান্তি পেতাম। হে ধরণী! দ্বিধা হও! আমি তন্মধ্যে প্রবেশ করি! ও ডিপজল ভাই! ও ডিপজল ভাই! আমার তোমার হাতের মার্কামারা ঘুষি খেতে কোনো আপত্তি নাই! "আমার ছবিটা একবার দেখে নিলেই আর হার্ট এট্যাক করতে হতো না। তাই না, ডাক্তার সাহেব? ওরফে হার্ট স্পেশালিস্ট।" জিভে কামড় দিয়ে ফেললাম। এ মেয়ে সব জানে। সারা সহজ গলায় বলল, "বিরক্তি, রাগ, তাড়া_ সবই ছিল অভিনয়। আচ্ছা, কেমন অভিনয় করি বললে না তো? বলো এবার কী করতে হবে! বিয়েটা ভেঙ্গে দেব? নাকি মত পাল্টানোর সম্ভাবনা আছে? বলে ফেলো! খামোখা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে কাজ নেই।" নিজের অজান্তেই ডান হাতটা বুকের বামপাশে চলে গেল। ধ্বক ধ্বক শব্দটা একটা কবিতার লাইন মনে করিয়ে দিল। মুখ ফুটে বেরিয়ে গেল- "বাজিল বুকে সুখের মত ব্যাথা!" হায়! এ যে দিনে দুপুরে ডাকাতি! সারা তার ডাকাতিয়া মায়াময় হাসি উপহার দিয়ে বলল, "তুমি ফেঁসে গেছ, ডাক্তার!" শেষ বিকেলের সোনালী আলোয় তার চলে যাওয়া দেখলাম আমি। লোকে বলে, কনে দেখা আলোয় সবাইকে সুন্দর দেখায়। কিন্তু তার আলোতে আমি কনে দেখা আলোটাকেও সুন্দর আর মায়াময় দেখলাম। আমি বসে রইলাম ক্যাকটাসের টবগুলোর পাশের চেয়ারে। আরও একটা ক্যাকটাসের মত, লুণ্ঠিত। আচ্ছা, সারা কি বিলটা পে করেছে? হুম। ডাক্তার এবার সত্যিই ফেঁসে গেছে। .......................................


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৪৭৫ জন


এ জাতীয় গল্প

→ হার্ট এটাক ( শেষ পর্ব )
→ হার্ট এটাক ( পর্ব-২ )
→ হার্ট এটাক ( পর্ব-১ )

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now
  • জেরিন
    Guest ৬ বছর, ১ মাস পুর্বে
    wow